PEN-PROLAY.
INK-ANANYA.
একটি সন্ধ্যার কথা
তখন সবে আমি ক্লাস থ্রি পাশ করে ফোরে উঠেছি। বয়স , জ্ঞান , অভিজ্ঞতা ,বিচার বুদ্ধির নিতান্তই হীন এবং অত্যন্ত দীন ও । সে দীনতা -হীনতার মাপকাঠি ? সে কথা আজ এই ২০১৫ সালে চৌত্রিশ বছরের যুবক হিসাবে ভাবতে বসলে মনের মাঝে যে অনুভুতিটা সর্বপ্রথম আসে সেটি বিচিত্র
।
ঘন অন্ধকার রাতে খোলা উঠোনে গাছ তলায় দাড়িয়ে থেকে ভয় পেয়েছি - মাঝ্ রাতে ঘুমের বিছানা থেকে এক টানে সোজা জঙ্গল ঘেরা উঠোনে - সে আরো কত ছোট তখন -- আমি সেই রাতের অন্ধকারে দেখেছি আমার ভাগ বাঁটোয়ারা হতে ---- কিন্তু তবুও আমি কান্নাকাটি করিনি - গাধার মতো চিৎকার করে একবারো আমার মা কে তো ডাকিনি ।
যাই হোক সেদিন শ্মশানে যাওয়ার সুযোগ এলো । তো স্বাভাবিক ভাবেই আমিও চললাম। সেই আমার প্রথম শ্মশানে যাওয়া ।
অথচ কতো না অতীতকাল থেকে কতো না প্রাণ স্পন্দনের অন্তিম পরিনতি হয়ে আছে এই শ্মশান ! -কতো না শোক তাপ জর্জরিত জীবনরুপি অভিষাপের মুক্তিধামের দরজা, জীবন আর অনন্তের মাঝের এক চিরকালীন সেতু, চিতার ওই তীব্র আগুন - ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকে কতো না আপেক্ষিকতা নিয়ে আজ আমার সামনে , ওই মন্দির আর ওই দেবী মূর্তি আমার জন্মের কত যুগ আগে থেকেই এখানে, যেন আমারই অপেক্ষায় ।
ওই বহতা ইছামতী কোন সে অজানা অতীত হতে জীবন মৃত্যুর এই মিলনভুমির পাশে পাশে বয়ে চলেছে সমান্তরাল ভাবে। অনেক বাধা কাটিয়ে , অনেক পথ পেরিয়ে সে দূর কোন সে পাহাড় থেকে আসে , বয়ে চলে , ধেয়ে চলে সাগর পানে - তবু সে তো নদীই থাকে। তার প্রানের প্রতি কনা জুড়ে যা থাকে সে তো সেই জল ই। চিরকালীন বহমানতা , এই চিরকালের যাত্রাপথ অতীত কাল থেকে তার তীরে আসা শব যাত্রীদের স্বান্তনা দিয়ে চলেছে -- ওই বয়ে চলা জলস্রোত যেন পরমাত্মার সমার্থক--- অতীত, বর্তমান ,ভবিষ্যত জুড়ে শুধুই অন্তহীন অসীমতার পানে ধেয়ে চলা। কেউ নেই, কিছুই নেই , কোথাও নেই - অথচ যেন সবেতেই সব কিছুই আছে।
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ওই চিতার আগুনের দিকে। ওই আগুনের মাঝে সেদিন্ যদি আমি আর কিছু দেখে থাকি তবে হয়ত সে ওই আগুনেরই নানা রং। জ্ঞানাবধি আমি জেনে এসেছি আমার মা মারা গেছে- সে অনেকদিন আগে। সে যে কত আগে তা আমি জানিনা আর জানার বিশেষ ইচ্ছেও ছিলোনা। যে নেই , সে হয়তো আসলেই কোথাওই আর নেই।
আজ বিকালেও বয়স্ক লোকের কান্না দেখে মনে মনে অবাক হয়েছি , - হেসেছি, - একটু আগেও এই শ্মশান দেখে মনে মনে হয়তো কিছুটা বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু আমার অজান্তে এই বহতা নদী, ওই বিপুল বট গাছ , ওই কালী মন্দির, ওই জ্বলন্ত চিতা --- যেন আমার বিমূর্ত মা এর প্রতিমূর্তি হয়ে আমায় ডাকতে লাগলো।
সে ছিলো আমার আশ্রয়। আমি ছিলাম তার মানসিক আর শারীরীক কামনার ফসল, তার সকল চেতনার প্রেরণা, তার বন্ধনহীনতার এক আশাময় বন্ধন যার অস্ত্বিত্ব পাওয়া যায় মাথার ভিতরে থাকা শিরা উপশিরায় বয়ে চলা রাসায়নিক কণায় । এই সেই পূণ্যভূমি যেখানে সে শেষ আশ্রয় নিয়েছিলো। এখানে এসে আমার প্রথম সাথীকে তার হাত দুটো ধরে অন্তিমকালে, " হে বন্ধু, বিদায় " - বলা আমারই দায়িত্ব ছিলো।
কিন্তু কালের নিয়মে তা হয়ে ওঠেনি । এই রকমই এক জ্বলন্ত চিতার আগুনে তিনি এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনের ইতি করে মিলিয়ে গিয়েছেন প্রকৃতির কোলে , তার জীবনের যাবতীয় স্বপ্ন , আনন্দ , ব্যথা , হতাশা ওই আগুনের ফুলকির মত নক্ষত্র হয়ে মিলিয়ে গিয়েছেন অসীম -অনন্ত -অজানা জগতে। তার বিদায়কালে আমি তার পাশে ছিলাম না।
কিন্তু এই মহা শ্মশানের সবকিছুই সেদিন তার সাথেই ছিল। তারা তার পাপ পুণ্য , দোষ গুন , -কোনকিছুই বিচার না করেই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সযত্নে তাকে তুলে দিয়েছে তার চিরকালের জগৎ জননীর কোলে। জীবনে এই প্রথমবার , এই একটি বার এই সন্ধ্যার অন্ধকারে দাড়িয়ে থেকে মা এর কথা ভেবে আমার দুই চোখ ভারী হয়ে আসে। যাকে আমি কখনোই দেখিনি , যাকে চিনিইনা, যার অস্তিত্বহীনতাই আমার কাছে তার একমাত্র অস্তিত্ব - সেই হতভাগিনী যুবতীর এর কথা ভেবে আমার দুটো চোখ জলে ভরে উঠলো।
ফিরে আসছি। পিছনে আর কেউ নেই। এখন সবার ফিরে চলার পালা । তবু যতো বার পারলাম পিছন ফিরে দেখলাম। আমার মা মোটেই অনেকদিন আগে মারা যায়নি। এখন এখানেই তার মৃত্যু হলো । এই সবে মাত্র কিছু আগে তার একমাত্র শিশু সন্তান জীবনে প্রথমবার চোখের জল ফেললো তার কথা ভেবে । আমার এই চোখের জলের মাঝেই তার মাতৃত্বের জন্ম আর মানসিক মৃত্যু ।
সেদিনের পর অনেক বছর কেটে গেছে।এই জীবনের উপর দিয়ে কত পরিচিত অপিরিচিত , আপন পর মানুষের যোগ বিয়োগ হয়ে গেল। আজ চৌত্রিশ বছরের যুবক।হিন্দু সন্তান হিসাবে মা এর মুখাগ্নি করিনি , নিয়ম মেনে কোনো শ্রাদ্ধ শান্তিও করিনি। আজকের আমি যুক্তির বিচারে সেসব প্রয়োজনও মনে করিনা ।
নিজেই জানি সময়ে অসময়ে তার স্বত্বার সাথে হয়তো কিছু বা অবিচারই করেছি। প্রকৃতির নিয়মেই আমি আমার স্বার্থের কথা ভেবেছি - সময় হয়নি তার বাধ্যতার কথা ভাবার । তবুও আমি আজ একটুও অনুতপ্ত নই। শাস্ত্র , সমাজ , আচার , লৌকিকতার উপর যদি মানবতা আর তার উপর যদি সত্যি শরীরের রাসায়নিক কণার মিলন বা বিচ্ছেদে সৃষ্ট - চিন্তা নামের কিছু থেকেই থাকে তবে আমার বিশ্বাস ওই সন্ধ্যায় আমার বিমূর্ত হতভাগিনী মা এর জন্যে ফেলা আমার দুই ফোটা চোখের জলেই তার সাথে আমার যাবতীয় দেনা-পাওনার হিসাব মিলে গেছে।
THANKS.
S.V.O
NEXT -যাত্রী
তবে সেদিনের একটা ক্লাস ফোরের ছেলেকে আজকের ক্লাস ফোরের ছেলের পাশে বসিয়ে বিচার করাটাও খুব যে যুক্তি সঙ্গত এবং নৈতিক - তাও কোনমতেই নয়।
কারণ তখনও আমাদের এই ছোট্ট সীমান্ত শহরের রাস্তায় মাঝে মাঝে দু একটা ঘোড়ার গাড়ি দেখা যেত , সন্ধ্যের অন্ধকার নামলে বেশির ভাগ বাড়ি থেকে হ্যারিকেনের আলোয় পড়তে বসা ছেলে মেয়েদের জোর গলায় পড়ার আওয়াজ পাওয়া যেত , মোটামুটি ইলেকট্রিক লাইন হাতে গোনা কিছু বাড়িতেই ছিল আর যে সব বাড়িতে টিভি ছিলো , তারা সময়ের বিচারে ছিলো যথেষ্ট ধনী ।
আসল কথা জীবনযাত্রার বিচারে ২০১৫ এর ইন্টারনেট , ফেসবুক আর শপিং মল থেকে প্রায় অনেক আলোকবর্ষ দুরের সে সময় । তবু সে সময় জন্মেই আমরা প্রায় কৈশোরে পা দিতাম না, কথা বলার আগেই কবিতা বলার স্কুলে ভর্তি হতাম না , আর child abuse শব্দটা এত পরিচিত ছিলোনা । জন্ম আর কৈশোরের মাঝে শৈশব নামের একটা পর্যায় ছিল এবং আমরা সাধ্যমত সেটার যাবতীয় রস পান করেছি ।
গরমের কারণে মর্নিং স্কুল চলছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই শুনি এক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই প্রবল কান্নাকাটি দেখে আমি সত্যি তাতে যথেষ্টই অবাক । বাড়ির পরিবেশ দেখে ঘটনার গুরুত্ব কিছুই না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম যে আজ আর রোজকারের মত আমার মাঠে খেলতে যাওয়া হলোনা। এই চরম আত্মত্যাগের পিছনে যে খুব বড় কোনো শোক তাপ ছিলোনা , বরং যেটা ছিল সেটা নিছকই এমন একটা দিনে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর পর জ্যাঠার প্রবল শাসনের ভয়।
সন্ধ্যের পর বাড়ির প্রায় সকলেই হাসপাতালে । আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আগে দু একবার সেখানে গিয়েছিলাম। জায়গাটা খুব ভালো বলে মনে হয়নি । ফলে আমি বাড়ি থেকে গেলাম বাড়ির কাজের মাসির সাথে।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম তিনি মারা গেছেন। আমার জীবনে দ্বিতীয় মৃত্যু সংবাদ। এর আগে পাশের বাড়ির এক অতি বয়স্ক লোক কে মরতে দেখেও একটুও খারাপ লাগেনি। নির্বোধ মনে যেটা সবথেকে বেশি লেগেছিল তার মৃত্যুতে, সেটা ভয়।
কিন্তু আজকের খবরে এই সকাল দশটায় দিনের আলোয় আমার কোনো ভয় এলোনা , অথচ কোনো বিশেষ শোক ও এলোনা। যেটা এলো , সেটা চরম বিরক্তি।
একে সেই কোন সকালে আমি স্কুলে গেছি - এখন একদিকে যেমন খুব ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত , তেমনি বাড়িতে তালা দেওয়া । এখন পিঠের এই ভারী ব্যাগটা নিয়ে আমি কোথায় কোথায় একা একা ঘুরে বেড়াবো ?
সকলের মুখেই শুধু বডি আনার কথা - একটা লোক , যে কালও বেঁচে ছিলো , অসুস্থ হলো , মরে গেলো - সে আর মানুষ নেই - সে একটা বডি হয়ে গেলো ? সত্যি বলতে এই মৃত্যুতে কোনো বিশেষ অনুভুতিই আমার আসেনি , তবু অকারনে মনটা খারাপ লাগতে লাগলো ! কেন খারাপ লেগেছিলো সেটা আজ বুঝি - পরিবেশের প্রভাব ।
কিন্তু বিকাল বেলায় তাকে সত্যি বাড়িতে আনা হলো আমি যথেষ্টই অবাক হলাম। এই তাহলে সেই বডি ? তিনি আর কারো কেউ নন , কেউ আর তার নয় । মানুষ মরলে এভাবে তার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়ে সে বডি হয়ে যায় ? কোথাও কিছুই নেই - ঘুম আর চিরঘুমের ফারাক বুঝলাম না । কিন্তু আমার সেদিন আরো অনেক কিছুই বোঝার এবং না বোঝার বাকী ছিলো । একটা মরে যাওয়া মানুষকে নিয়ে কতোরকম কান্না করা যায় , মাটিতে গড়াগড়ি করতে হয় - এসবের কোন ধারনাই আমার ছিলোনা ।
আসল কথা জীবনযাত্রার বিচারে ২০১৫ এর ইন্টারনেট , ফেসবুক আর শপিং মল থেকে প্রায় অনেক আলোকবর্ষ দুরের সে সময় । তবু সে সময় জন্মেই আমরা প্রায় কৈশোরে পা দিতাম না, কথা বলার আগেই কবিতা বলার স্কুলে ভর্তি হতাম না , আর child abuse শব্দটা এত পরিচিত ছিলোনা । জন্ম আর কৈশোরের মাঝে শৈশব নামের একটা পর্যায় ছিল এবং আমরা সাধ্যমত সেটার যাবতীয় রস পান করেছি ।
গরমের কারণে মর্নিং স্কুল চলছিল। একদিন স্কুল থেকে ফিরেই শুনি এক আত্মীয় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বাড়িতে স্বাভাবিকভাবেই প্রবল কান্নাকাটি দেখে আমি সত্যি তাতে যথেষ্টই অবাক । বাড়ির পরিবেশ দেখে ঘটনার গুরুত্ব কিছুই না বুঝলেও এটুকু বুঝলাম যে আজ আর রোজকারের মত আমার মাঠে খেলতে যাওয়া হলোনা। এই চরম আত্মত্যাগের পিছনে যে খুব বড় কোনো শোক তাপ ছিলোনা , বরং যেটা ছিল সেটা নিছকই এমন একটা দিনে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ানোর পর জ্যাঠার প্রবল শাসনের ভয়।
সন্ধ্যের পর বাড়ির প্রায় সকলেই হাসপাতালে । আমাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল, কিন্তু আগে দু একবার সেখানে গিয়েছিলাম। জায়গাটা খুব ভালো বলে মনে হয়নি । ফলে আমি বাড়ি থেকে গেলাম বাড়ির কাজের মাসির সাথে।
পরদিন স্কুল থেকে ফিরে শুনলাম তিনি মারা গেছেন। আমার জীবনে দ্বিতীয় মৃত্যু সংবাদ। এর আগে পাশের বাড়ির এক অতি বয়স্ক লোক কে মরতে দেখেও একটুও খারাপ লাগেনি। নির্বোধ মনে যেটা সবথেকে বেশি লেগেছিল তার মৃত্যুতে, সেটা ভয়।
কিন্তু আজকের খবরে এই সকাল দশটায় দিনের আলোয় আমার কোনো ভয় এলোনা , অথচ কোনো বিশেষ শোক ও এলোনা। যেটা এলো , সেটা চরম বিরক্তি।
একে সেই কোন সকালে আমি স্কুলে গেছি - এখন একদিকে যেমন খুব ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত , তেমনি বাড়িতে তালা দেওয়া । এখন পিঠের এই ভারী ব্যাগটা নিয়ে আমি কোথায় কোথায় একা একা ঘুরে বেড়াবো ?
সকলের মুখেই শুধু বডি আনার কথা - একটা লোক , যে কালও বেঁচে ছিলো , অসুস্থ হলো , মরে গেলো - সে আর মানুষ নেই - সে একটা বডি হয়ে গেলো ? সত্যি বলতে এই মৃত্যুতে কোনো বিশেষ অনুভুতিই আমার আসেনি , তবু অকারনে মনটা খারাপ লাগতে লাগলো ! কেন খারাপ লেগেছিলো সেটা আজ বুঝি - পরিবেশের প্রভাব ।
কিন্তু বিকাল বেলায় তাকে সত্যি বাড়িতে আনা হলো আমি যথেষ্টই অবাক হলাম। এই তাহলে সেই বডি ? তিনি আর কারো কেউ নন , কেউ আর তার নয় । মানুষ মরলে এভাবে তার সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়ে সে বডি হয়ে যায় ? কোথাও কিছুই নেই - ঘুম আর চিরঘুমের ফারাক বুঝলাম না । কিন্তু আমার সেদিন আরো অনেক কিছুই বোঝার এবং না বোঝার বাকী ছিলো । একটা মরে যাওয়া মানুষকে নিয়ে কতোরকম কান্না করা যায় , মাটিতে গড়াগড়ি করতে হয় - এসবের কোন ধারনাই আমার ছিলোনা ।
সত্যি কথা বলতে মনে যখন সবেমাত্র শোক শুরু হতে চলেছে , সেই সব বয়স্ক লোকের কান্নায় সে শোক গেলো উড়ে - হাসি আসতে লাগলো এসব দেখে ।
সেই জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই আমি শুনে আসছি আমার মাত্র দেড় বছর বয়সে আমার মা নাকি মারা গেছে। কারণ তিনি নাকি মরতেই চেয়েছিলেন ----- ...............।
একজন সাধারন মানুষ - শুধু মরতেই চেয়েছিলেন ?
আজ বুঝি তার মরার ব্যাপারটা আসলে ছিলো তার সামান্য এক দৈহিক আত্মহত্যা। নিজের কাছে তার মানষিক মরণ অনেক আগেই হয়েছিল । স্কুলে দেখেছি কারো মা না এসে থাকলে তাকে কান্না করতে , মা স্কুল থেকে বাড়ি গেলে কান্না করতে । কিন্তু আমি সেই বোকাদের বা ভীতুদের দলের কেউ নই । আমি তো কখনো এভাবে বোকার মত কান্না করিনি জীবনে । কেউ যেন সেই বয়সেই আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলো , কান্না করা সকলের জন্য নয় ।
দাদুর বাড়িতে বিনা কারনে নির্বিচারে মার খেয়েছি - মারের চোটে কুকুরের মতো গুটিয়ে গিয়েছি- মার খেতে খেতে টেবিলের তলায় ঢুকে গেছি , সেখান থেকে টেনে এনে আবার মেরেছে । আমার কান্না ছিলোনা । ছিলো সারা গায়ের সাদাটে চামড়ায় লাল লাল দাগ ।
আজ বুঝি তার মরার ব্যাপারটা আসলে ছিলো তার সামান্য এক দৈহিক আত্মহত্যা। নিজের কাছে তার মানষিক মরণ অনেক আগেই হয়েছিল । স্কুলে দেখেছি কারো মা না এসে থাকলে তাকে কান্না করতে , মা স্কুল থেকে বাড়ি গেলে কান্না করতে । কিন্তু আমি সেই বোকাদের বা ভীতুদের দলের কেউ নই । আমি তো কখনো এভাবে বোকার মত কান্না করিনি জীবনে । কেউ যেন সেই বয়সেই আমায় শিখিয়ে দিয়েছিলো , কান্না করা সকলের জন্য নয় ।
দাদুর বাড়িতে বিনা কারনে নির্বিচারে মার খেয়েছি - মারের চোটে কুকুরের মতো গুটিয়ে গিয়েছি- মার খেতে খেতে টেবিলের তলায় ঢুকে গেছি , সেখান থেকে টেনে এনে আবার মেরেছে । আমার কান্না ছিলোনা । ছিলো সারা গায়ের সাদাটে চামড়ায় লাল লাল দাগ ।
ঘন অন্ধকার রাতে খোলা উঠোনে গাছ তলায় দাড়িয়ে থেকে ভয় পেয়েছি - মাঝ্ রাতে ঘুমের বিছানা থেকে এক টানে সোজা জঙ্গল ঘেরা উঠোনে - সে আরো কত ছোট তখন -- আমি সেই রাতের অন্ধকারে দেখেছি আমার ভাগ বাঁটোয়ারা হতে ---- কিন্তু তবুও আমি কান্নাকাটি করিনি - গাধার মতো চিৎকার করে একবারো আমার মা কে তো ডাকিনি ।
যাই হোক সেদিন শ্মশানে যাওয়ার সুযোগ এলো । তো স্বাভাবিক ভাবেই আমিও চললাম। সেই আমার প্রথম শ্মশানে যাওয়া ।
আজ ভাবি আরো আগেই হয়তো আসার কথা ছিলো এখানে । অন্যের কাছে বয়সটা অনেক কম , কিন্তু আমার তো তা নয় ।
সেই শুরু ----- - তারপর থেকে পরিচিত , অপরিচিত ---- কতো মানুষকেই তো রেখে এলাম ।
শুধু যে মানুষকে বিদায় দিয়েছি তা তো নয়। এখানে এসেছি কারনে -অকারনে । একটা অজানা টান । জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছিলাম ।
সেই শুরু ----- - তারপর থেকে পরিচিত , অপরিচিত ---- কতো মানুষকেই তো রেখে এলাম ।
শুধু যে মানুষকে বিদায় দিয়েছি তা তো নয়। এখানে এসেছি কারনে -অকারনে । একটা অজানা টান । জায়গাটার প্রেমে পড়ে গেছিলাম ।
সন্ধ্যার অন্ধকারে জ্বলন্ত চিতার লাল আগুনের থেকে ছুটে যাওয়া ফুলকির ভিতর এক অজানা ভালোলাগা পেয়েছি । নিস্তব্ধ শ্মশান , বটের ছায়া , লেলিহান চিতা , ক্লান্ত শববাহকের দল , - সবকিছুর সাথে একটা আলাদা টান অনুভব করি আজও ।
এখানেই তাই আশ্বাস ও দিয়েছি - এক প্রেমিকা জানতে চেয়েছিলো , " আমাদের পথ কি কোনদিনই এক হবেনা ? "
ঘুরতে ঘুরতে সেই শ্মশান ভরসা- এখানেই এসেছিলাম আমরা । তাকে বলেছিলাম " ভয় কি ? আজ না হোক কাল - এখানেই আবার আমাদের দেখা হবে --হবেই " ।
হয়তো সেই আত্মীয় আমাকেও যথেষ্টই স্নেহ করতেন। কিন্তু সেই স্নেহ ছিল একতারার সুরের মতো, সেতারের মতো কখনোই হয়নি। উনি আমার প্রতি নিশ্চয়ই আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু আমার অন্তর থাকতো অন্য কোথাও- সে হতে পারে স্কুলের বন্ধু ঝুমের বাড়ি , দিদির বাড়ির মেঠোপথের দিকে অথবা দাদুরবাড়ির চারপাশের জংগল আর অজস্র স্বাধীন সমবয়সী বন্ধু আর সন্ধ্যার ইচ্ছামতী নদীর দিকে । যেখানে দিনের শেষে গরমের সময় কালো সন্ধ্যার অন্ধ জলে দল বেঁধে দিদার সাথে স্নান করাটা আমার নিয়ম ছিলো। দিদাকে ধরে জলে ঝাঁপানো ছিলো আমার অধিকার , দাদুর চোখরাঙ্গানি কে কাঁচকলা দেখিয়ে দিদার প্রশ্রয় আমার আশ্রয় - আরো অনেক পরে পাড়াগাঁয়ের অন্ধকার ঘেরা পথ ধরে দিদার সাথে বাড়ী ফেরা - অথবা প্রচন্ড গরমের দুপুরে দিদির বাড়ির আমবাগানে ঘোরা , ছাগল আর মুর্গীর সাথে দৌড়ে বেড়ানোই ছিলো আমার অভ্যাস আর স্বপ্ন । আমার ছুটি ছিলো শুধুই ছুটি । সুতরাং আমার আর তার বাড়ির বাচ্চাদের শোকের মাঝে যথেষ্টই ফারাক ছিল।
আমি জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই মাতৃহারা । এক উঠোনে থাকা স্বত্তেও বাবার সংগ পাইনা , ঠাকুর্দা , ঠাকুরমা - এসব আমার কাছে ছিলো বিলাসীতা । নিজের বিন্দুমাত্রও দোষ না থাকা স্বত্তেও আরো কত ছোট বয়সেই দাদুর হাতে নির্বিচারে মার খেয়েছি। ফলে আমার নিজের কাছে আমার বাড়ির লোক নিয়েই আমার জগৎ ছিল। দাদু বা ঠাকুর্দা - আমার কাছে তাদের মত কোনো গল্পের আসর বা আদর আব্দারের আশ্রয় ছিলনা। ফলে অনেকের কাছেই যেটা চরম শোকের, আমার শিশুমনে সেটা খুব সামান্য এক ঘটনা মাত্র।
কিন্তু এই বৃহৎ সংসারে কেই বা কবে ক্ষুদ্র শিশুর মন নিয়ে ভেবেছে ?
ঘুরতে ঘুরতে সেই শ্মশান ভরসা- এখানেই এসেছিলাম আমরা । তাকে বলেছিলাম " ভয় কি ? আজ না হোক কাল - এখানেই আবার আমাদের দেখা হবে --হবেই " ।
হয়তো সেই আত্মীয় আমাকেও যথেষ্টই স্নেহ করতেন। কিন্তু সেই স্নেহ ছিল একতারার সুরের মতো, সেতারের মতো কখনোই হয়নি। উনি আমার প্রতি নিশ্চয়ই আন্তরিক ছিলেন, কিন্তু আমার অন্তর থাকতো অন্য কোথাও- সে হতে পারে স্কুলের বন্ধু ঝুমের বাড়ি , দিদির বাড়ির মেঠোপথের দিকে অথবা দাদুরবাড়ির চারপাশের জংগল আর অজস্র স্বাধীন সমবয়সী বন্ধু আর সন্ধ্যার ইচ্ছামতী নদীর দিকে । যেখানে দিনের শেষে গরমের সময় কালো সন্ধ্যার অন্ধ জলে দল বেঁধে দিদার সাথে স্নান করাটা আমার নিয়ম ছিলো। দিদাকে ধরে জলে ঝাঁপানো ছিলো আমার অধিকার , দাদুর চোখরাঙ্গানি কে কাঁচকলা দেখিয়ে দিদার প্রশ্রয় আমার আশ্রয় - আরো অনেক পরে পাড়াগাঁয়ের অন্ধকার ঘেরা পথ ধরে দিদার সাথে বাড়ী ফেরা - অথবা প্রচন্ড গরমের দুপুরে দিদির বাড়ির আমবাগানে ঘোরা , ছাগল আর মুর্গীর সাথে দৌড়ে বেড়ানোই ছিলো আমার অভ্যাস আর স্বপ্ন । আমার ছুটি ছিলো শুধুই ছুটি । সুতরাং আমার আর তার বাড়ির বাচ্চাদের শোকের মাঝে যথেষ্টই ফারাক ছিল।
আমি জ্ঞান হওয়ার আগে থেকেই মাতৃহারা । এক উঠোনে থাকা স্বত্তেও বাবার সংগ পাইনা , ঠাকুর্দা , ঠাকুরমা - এসব আমার কাছে ছিলো বিলাসীতা । নিজের বিন্দুমাত্রও দোষ না থাকা স্বত্তেও আরো কত ছোট বয়সেই দাদুর হাতে নির্বিচারে মার খেয়েছি। ফলে আমার নিজের কাছে আমার বাড়ির লোক নিয়েই আমার জগৎ ছিল। দাদু বা ঠাকুর্দা - আমার কাছে তাদের মত কোনো গল্পের আসর বা আদর আব্দারের আশ্রয় ছিলনা। ফলে অনেকের কাছেই যেটা চরম শোকের, আমার শিশুমনে সেটা খুব সামান্য এক ঘটনা মাত্র।
কিন্তু এই বৃহৎ সংসারে কেই বা কবে ক্ষুদ্র শিশুর মন নিয়ে ভেবেছে ?
সেই পুরানো ইছামতী নদীর পাড়ের একটা অতি সামান্য জায়গা , একপাশে একটা বিশাল বড় বটতলায় হাহাকার করে আগুন জ্বলছে - নাম তার চিতা । আর তার কিছু পাশে একটা ভাঙ্গাচোরা কালী মন্দির। একটা বডি ওই আগুনের শিখার মাঝে। কিন্তু আমার নির্বোধ চোখ জুড়ে কি অনাবিল বিস্ময়। বারে বারে শয়ে শয়ে , হাজারে হাজারে - আগুনের ছোট ছোট ফুলকি উঠেই চলছে , যেন হাজার হাজার নক্ষত্র ওই চিতার আগুন থেকে তৈরি হয়েই চলছে - এই চলার বুঝি কোনো নেই। কাউকেই ওই আগুনের মাঝে এখন আর একটুও কোথাও দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু আমাদের সকলের চোখের সামনে অগনিত নক্ষত্রের মত একটু একটু করে তিনি যেন মিশে যাচ্ছেন ওই নদীর বুকে , ওই বট গাছটার মাঝে , ওই কালো আকাশের মাঝে। আগুনের হাজার হাজার ফুলকির মাঝেই বিলীয়মান জীবনের চেতনা, স্বপ্ন, বিশ্বাস ।
বিস্মিত , ক্ষুদ্র , নির্বোধ বালক আমি। এর থেকে বেশি কি বা আর আমি ভাবতে পারি ?
কতো না সাধারণ এই ক্ষণ , এই স্থান , এই লোক সমাগম ?
কতো না সাধারণ এই ক্ষণ , এই স্থান , এই লোক সমাগম ?
অথচ কতো না অতীতকাল থেকে কতো না প্রাণ স্পন্দনের অন্তিম পরিনতি হয়ে আছে এই শ্মশান ! -কতো না শোক তাপ জর্জরিত জীবনরুপি অভিষাপের মুক্তিধামের দরজা, জীবন আর অনন্তের মাঝের এক চিরকালীন সেতু, চিতার ওই তীব্র আগুন - ইতিহাসের সেই আদিকাল থেকে কতো না আপেক্ষিকতা নিয়ে আজ আমার সামনে , ওই মন্দির আর ওই দেবী মূর্তি আমার জন্মের কত যুগ আগে থেকেই এখানে, যেন আমারই অপেক্ষায় ।
কতো না সূর্য ওঠা নতুন ভোরে বা নিশুতির গভীর অন্ধকারে কতো না হতভাগিনীর দল তাদের স্তন আঁকড়ে থাকা কোলের শিশুটিকে , অথবা কতো অজানা উপকারী বন্ধু অচেনা পথিক কে রেখে গেছে এই নদীপ্রান্তরে । হটাৎ করেই যেন তার জাগতিক পালা আজ সাঙ্গ হলো , তাই এত দিনের সঙ্গীরা তাকে ফিরিরে দিল তাকে চিরকালের কোলে - তার চিরকালের আশ্রয়ে।
ওই সুপ্রাচীন বট গাছ কত না ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের চিরকালীন আশ্রয়দাতা -কত অগনিত জীবনের ক্লান্ত , শ্রান্ত পথিক এই জগতের মায়া কাটিয়ে যাওয়ার আগে এর স্নিগ্ধ ছায়াতলে নিজেকে জুড়িয়ে নিয়েছে শেষ বারের মত।
ওই সুপ্রাচীন বট গাছ কত না ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবের চিরকালীন আশ্রয়দাতা -কত অগনিত জীবনের ক্লান্ত , শ্রান্ত পথিক এই জগতের মায়া কাটিয়ে যাওয়ার আগে এর স্নিগ্ধ ছায়াতলে নিজেকে জুড়িয়ে নিয়েছে শেষ বারের মত।
ওই বহতা ইছামতী কোন সে অজানা অতীত হতে জীবন মৃত্যুর এই মিলনভুমির পাশে পাশে বয়ে চলেছে সমান্তরাল ভাবে। অনেক বাধা কাটিয়ে , অনেক পথ পেরিয়ে সে দূর কোন সে পাহাড় থেকে আসে , বয়ে চলে , ধেয়ে চলে সাগর পানে - তবু সে তো নদীই থাকে। তার প্রানের প্রতি কনা জুড়ে যা থাকে সে তো সেই জল ই। চিরকালীন বহমানতা , এই চিরকালের যাত্রাপথ অতীত কাল থেকে তার তীরে আসা শব যাত্রীদের স্বান্তনা দিয়ে চলেছে -- ওই বয়ে চলা জলস্রোত যেন পরমাত্মার সমার্থক--- অতীত, বর্তমান ,ভবিষ্যত জুড়ে শুধুই অন্তহীন অসীমতার পানে ধেয়ে চলা। কেউ নেই, কিছুই নেই , কোথাও নেই - অথচ যেন সবেতেই সব কিছুই আছে।
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ওই চিতার আগুনের দিকে। ওই আগুনের মাঝে সেদিন্ যদি আমি আর কিছু দেখে থাকি তবে হয়ত সে ওই আগুনেরই নানা রং। জ্ঞানাবধি আমি জেনে এসেছি আমার মা মারা গেছে- সে অনেকদিন আগে। সে যে কত আগে তা আমি জানিনা আর জানার বিশেষ ইচ্ছেও ছিলোনা। যে নেই , সে হয়তো আসলেই কোথাওই আর নেই।
স্বার্থহীন মৃত বেক্তি আর বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানা হয়তো এক । শেষ মানে শেষ ।
আমার এইটুকু জীবনের সমগ্র স্মৃতিভান্ডার খুজলেও তার সামান্য মুখখানিও আমার মনে আসেনা , আমি তাকে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে একবারও মা বলেও ডাকিনি। সে হতভাগিনী আমার এই ছোট্ট সামান্য জীবনে কতো ক্ষনস্থায়ী - সে শুধু সেই জানে। তবু আজ এই ভর সন্ধ্যায় , এই শ্মশানে , এই অগনিত আত্মীয় পরিজনের মাঝেও ওই জ্বলন্ত চিতার সামনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার নিজের হতভাগিনী মা এর কথাটাই আমার মনে এলো। নিজের বলতে একেবারেই নিজের। অথচ আজ আর তার কোথাও কোন আকার নেই , শব্দ নেই , রূপ নেই , কোনো কাল্পনিক অবয়বও নেই আমার কাছে । আসলেই এতদিনে হয়তো তার আর কিছুই নেই। আজ থেকে বহুদিন আগে তিনি যখন এখানে এসেছিলেন , আজ আর সেই দিনও নেই। আজ সবকিছু ঘিরেই শুধই আজকের সময় । আজ তিনি পুরানো , জীবন মৃত্যুর মায়াজালে হারিয়ে যাওয়া এক নিতান্তই পরিত্যক্ত অধ্যায়।
আমার এইটুকু জীবনের সমগ্র স্মৃতিভান্ডার খুজলেও তার সামান্য মুখখানিও আমার মনে আসেনা , আমি তাকে আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে একবারও মা বলেও ডাকিনি। সে হতভাগিনী আমার এই ছোট্ট সামান্য জীবনে কতো ক্ষনস্থায়ী - সে শুধু সেই জানে। তবু আজ এই ভর সন্ধ্যায় , এই শ্মশানে , এই অগনিত আত্মীয় পরিজনের মাঝেও ওই জ্বলন্ত চিতার সামনে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার নিজের হতভাগিনী মা এর কথাটাই আমার মনে এলো। নিজের বলতে একেবারেই নিজের। অথচ আজ আর তার কোথাও কোন আকার নেই , শব্দ নেই , রূপ নেই , কোনো কাল্পনিক অবয়বও নেই আমার কাছে । আসলেই এতদিনে হয়তো তার আর কিছুই নেই। আজ থেকে বহুদিন আগে তিনি যখন এখানে এসেছিলেন , আজ আর সেই দিনও নেই। আজ সবকিছু ঘিরেই শুধই আজকের সময় । আজ তিনি পুরানো , জীবন মৃত্যুর মায়াজালে হারিয়ে যাওয়া এক নিতান্তই পরিত্যক্ত অধ্যায়।
এই সময়ের আড়ালে , সকলের আড়ালে - আমি আস্তে আস্তে আলাদা হয়ে যাচ্ছি - আমার চিন্তা জুড়ে নেমে আসছে অন্য কিছু - আমি সকলের থেকে দূরে - কিন্তু একা নই । আমি একা , কিন্তু একাকিত্বের হীনতা নেই। এক অজানা , অচেনা মায়াজালের দিকে পরম ভরসায় আমি যেন এগিয়ে চলেছি । যেখানে আমার ভয় নেই , চিন্তা নেই , উৎকণ্ঠা নেই - আছে শুধুই এক আকর্ষণ , যাকে উপেক্ষা করার ক্ষমতাও আমার নেই ।
আজ বিকালেও বয়স্ক লোকের কান্না দেখে মনে মনে অবাক হয়েছি , - হেসেছি, - একটু আগেও এই শ্মশান দেখে মনে মনে হয়তো কিছুটা বিরক্ত হয়েছি। কিন্তু আমার অজান্তে এই বহতা নদী, ওই বিপুল বট গাছ , ওই কালী মন্দির, ওই জ্বলন্ত চিতা --- যেন আমার বিমূর্ত মা এর প্রতিমূর্তি হয়ে আমায় ডাকতে লাগলো।
সে ছিলো আমার আশ্রয়। আমি ছিলাম তার মানসিক আর শারীরীক কামনার ফসল, তার সকল চেতনার প্রেরণা, তার বন্ধনহীনতার এক আশাময় বন্ধন যার অস্ত্বিত্ব পাওয়া যায় মাথার ভিতরে থাকা শিরা উপশিরায় বয়ে চলা রাসায়নিক কণায় । এই সেই পূণ্যভূমি যেখানে সে শেষ আশ্রয় নিয়েছিলো। এখানে এসে আমার প্রথম সাথীকে তার হাত দুটো ধরে অন্তিমকালে, " হে বন্ধু, বিদায় " - বলা আমারই দায়িত্ব ছিলো।
কিন্তু কালের নিয়মে তা হয়ে ওঠেনি । এই রকমই এক জ্বলন্ত চিতার আগুনে তিনি এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনের ইতি করে মিলিয়ে গিয়েছেন প্রকৃতির কোলে , তার জীবনের যাবতীয় স্বপ্ন , আনন্দ , ব্যথা , হতাশা ওই আগুনের ফুলকির মত নক্ষত্র হয়ে মিলিয়ে গিয়েছেন অসীম -অনন্ত -অজানা জগতে। তার বিদায়কালে আমি তার পাশে ছিলাম না।
কিন্তু এই মহা শ্মশানের সবকিছুই সেদিন তার সাথেই ছিল। তারা তার পাপ পুণ্য , দোষ গুন , -কোনকিছুই বিচার না করেই তাকে আশ্রয় দিয়েছিল। সযত্নে তাকে তুলে দিয়েছে তার চিরকালের জগৎ জননীর কোলে। জীবনে এই প্রথমবার , এই একটি বার এই সন্ধ্যার অন্ধকারে দাড়িয়ে থেকে মা এর কথা ভেবে আমার দুই চোখ ভারী হয়ে আসে। যাকে আমি কখনোই দেখিনি , যাকে চিনিইনা, যার অস্তিত্বহীনতাই আমার কাছে তার একমাত্র অস্তিত্ব - সেই হতভাগিনী যুবতীর এর কথা ভেবে আমার দুটো চোখ জলে ভরে উঠলো।
ফিরে আসছি। পিছনে আর কেউ নেই। এখন সবার ফিরে চলার পালা । তবু যতো বার পারলাম পিছন ফিরে দেখলাম। আমার মা মোটেই অনেকদিন আগে মারা যায়নি। এখন এখানেই তার মৃত্যু হলো । এই সবে মাত্র কিছু আগে তার একমাত্র শিশু সন্তান জীবনে প্রথমবার চোখের জল ফেললো তার কথা ভেবে । আমার এই চোখের জলের মাঝেই তার মাতৃত্বের জন্ম আর মানসিক মৃত্যু ।
সেদিনের পর অনেক বছর কেটে গেছে।এই জীবনের উপর দিয়ে কত পরিচিত অপিরিচিত , আপন পর মানুষের যোগ বিয়োগ হয়ে গেল। আজ চৌত্রিশ বছরের যুবক।হিন্দু সন্তান হিসাবে মা এর মুখাগ্নি করিনি , নিয়ম মেনে কোনো শ্রাদ্ধ শান্তিও করিনি। আজকের আমি যুক্তির বিচারে সেসব প্রয়োজনও মনে করিনা ।
নিজেই জানি সময়ে অসময়ে তার স্বত্বার সাথে হয়তো কিছু বা অবিচারই করেছি। প্রকৃতির নিয়মেই আমি আমার স্বার্থের কথা ভেবেছি - সময় হয়নি তার বাধ্যতার কথা ভাবার । তবুও আমি আজ একটুও অনুতপ্ত নই। শাস্ত্র , সমাজ , আচার , লৌকিকতার উপর যদি মানবতা আর তার উপর যদি সত্যি শরীরের রাসায়নিক কণার মিলন বা বিচ্ছেদে সৃষ্ট - চিন্তা নামের কিছু থেকেই থাকে তবে আমার বিশ্বাস ওই সন্ধ্যায় আমার বিমূর্ত হতভাগিনী মা এর জন্যে ফেলা আমার দুই ফোটা চোখের জলেই তার সাথে আমার যাবতীয় দেনা-পাওনার হিসাব মিলে গেছে।
THANKS.
S.V.O
NEXT -যাত্রী
3 Comments
https://youtu.be/LLTNi1300dc
Ph no. 9073164828
https://youtu.be/LLTNi1300dc
Ph no. 9073164828